ইয়াজুজ মাজুজ কারা? ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক বিশ্লেষণ

ইসলামের অন্তকাল বিষয়ক অন্যতম রহস্যময় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইয়াজুজ ও মাজুজ। কুরআন, হাদীস এবং বিভিন্ন তাফসিরে এদের বর্ণনা পাওয়া যায়, যা মানব ইতিহাস ও কিয়ামতের পূর্ব সংকেত হিসেবে বিবেচিত। আধুনিক যুগেও ইয়াজুজ-মাজুজ নিয়ে নানা গবেষণা ও মতামত রয়েছে। এই ব্লগে আমরা ইসলামের মূল সূত্র, তাফসিরের ব্যাখ্যা এবং আধুনিক গবেষণার আলোকে ইয়াজুজ-মাজুজের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ইয়াজুজ-মাজুজ: পরিচিতি ও প্রেক্ষাপট
ইয়াজুজ ও মাজুজ হল দুটি জাতি বা জনগোষ্ঠী, যাদের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসে উল্লেখ করেছেন। তাদের প্রকৃতি, অবস্থান, ক্ষমতা এবং কিয়ামতের পূর্বের ভূমিকা রহস্যময় ও ভয়ংকর। তারা একসময় পৃথিবীতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। ইসলামী এস্ক্যাটোলজির (end-times theology) গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ইয়াজুজ-মাজুজকে ধরা হয় কিয়ামতের বড় আলামতগুলোর মধ্যে।
কুরআনের আয়াতে ইয়াজুজ-মাজুজের বর্ণনা
আল-কুরআনে ইয়াজুজ ও মাজুজের উল্লেখ প্রধানত দুটি স্থানে পাওয়া যায় —
সূরা কাহফ (১৮:৯৪)
“তারা বললো: হে যুলকারনাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ এ দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। আমরা তোমাকে একটি বাধা হিসেবে প্রাচীর নির্মাণ করতে বলি, যাতে তারা আর আমাদের ওপর আক্রমণ করতে না পারে।”
সূরা আম্বিয়া (২১:৯৬)
“এমন এক সময় আমরা ইয়াজুজ ও মাজুজদের ছেড়ে দিব, তারা প্রতিটি উচ্চ স্থান থেকে ধাবিত হবে।”
এই আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, ইয়াজুজ ও মাজুজ এমন একটি ভয়ংকর জাতি যারা কিয়ামতের আগে পৃথিবীতে বড় বিপদ সৃষ্টি করবে এবং যুলকারনাইন নামে এক ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি তাদের আটকে রেখেছিল।
ইয়াজুজ-মাজুজের সম্পর্কে হাদীসের বর্ণনা
সহীহ হাদীসগুলোতে ইয়াজুজ ও মাজুজের ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে সময় ইয়াজুজ ও মাজুজ বের হবে, তখন তাদের ধ্বংসযজ্ঞ এতটাই ভয়াবহ হবে যে, হাজার মানুষের মধ্যে ৯৯৯ জন তাদের কবলে পড়বে।
একটি উল্লেখযোগ্য হাদীসে বলা হয়, তারা এক বিশাল পাহাড়ের মত প্রাচীরের পেছনে আবদ্ধ আছে, যা যুলকারনাইন নির্মাণ করেছিলেন। তাদের মুক্তি কিয়ামতের বড় আলামত, এবং মুক্তির পর তারা পৃথিবীতে ব্যাপক ধ্বংস সৃষ্টি করবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাদের এক বিশেষ কীট বা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ধ্বংস করবেন।
যুলকারনাইন ও তার প্রাচীর
যুলকারনাইন ছিলেন এক শক্তিশালী ও ন্যায়পরায়ণ শাসক, যিনি আল্লাহর নির্দেশে ইয়াজুজ-মাজুজের আক্রমণ ঠেকাতে এক বিশাল প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। কুরআন এই প্রাচীরের নির্মাণ প্রক্রিয়া বর্ণনা করে (সূরা কাহফ ৯৫-৯৬):
“আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যখানে একটি প্রাচীর তৈরি করব। তোমরা আমাকে লোহার পাত এনে দাও…”
অনেক গবেষক মনে করেন, এটি হয়তো কোনো প্রকৃত লোহার প্রাচীর বা শক্তিশালী প্রাকৃতিক দুর্গ। আধুনিক স্কলাররা অনুমান করেন, এটি ককেশাস অঞ্চলের পর্বতশ্রেণী বা প্রাচীন কোনো দুর্গ হতে পারে।
তাফসিরকারকদের মতামত
ইবনে কাসীর, আল-আলুসী, কুরতুবী, তাবারীসহ বিখ্যাত তাফসিরকারীরা ইয়াজুজ-মাজুজকে মানব জাতিরই অন্তর্ভুক্ত হিসেবে দেখেছেন, তবে তারা ছিলেন অত্যন্ত হিংস্র ও বিপজ্জনক। ইবনে কাসীর বলেন, তারা বনী আদমের অন্তর্ভুক্ত এবং পৃথিবীতে বড় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাবে। আল-আলুসী বলছেন, তারা সভ্যতা ও শিষ্টাচারের বাইরে বর্বর জাতি।
তাদের সম্পর্কে এসব তাফসিরের ব্যাখ্যা আমাদের বোঝায়, ইয়াজুজ-মাজুজ কোনো কাল্পনিক বা পৌরাণিক চরিত্র নয়, বরং বাস্তব বিশ্বের এক ভয়াবহ অংশ হতে পারে।
আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণ
বর্তমান সময়ে ইয়াজুজ-মাজুজ নিয়ে বিভিন্ন আধুনিক ব্যাখ্যা ও মতামত প্রচলিত।
- কিছু গবেষক মনে করেন, ইয়াজুজ-মাজুজের বর্ণনা চীনা, মঙ্গোলিয়ান বা ইউরোপীয় ধ্বংসাত্মক গোত্রের প্রতীক হতে পারে, যারা ইতিহাসে বড় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে।
- কেউ মনে করেন, তারা ভবিষ্যতের কোনো সুপার রেস বা ভয়ংকর জেনেটিক জাতি, যা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে সৃষ্টি হতে পারে।
- অন্যরা বলেন, ইয়াজুজ-মাজুজ আসলে আধুনিক গণবিধ্বংসী অস্ত্র বা জৈব-অস্ত্রের প্রতীক।
এই সব মতবাদসমূহ মূলত ইয়াজুজ-মাজুজের রহস্যময়তা ও ভয়ংকরতা বোঝানোর চেষ্টা।
ইয়াজুজ-মাজুজের অবস্থান
কথিত আছে, তারা এখনো যুলকারনাইনের প্রাচীরের পেছনে আবদ্ধ আছে।
কিন্তু কোথায় তারা আছেন? এটি এখনও স্পষ্ট নয়।
- ইসলামী তাফসিরকারগণ মনে করেন, তারা পৃথিবীর কোনো নির্জন অঞ্চলে লুকিয়ে আছে।
- আধুনিক গবেষকরা বিভিন্ন সম্ভাব্য স্থান যেমন ককেশাস, ইউরোপ-এশিয়া সীমান্ত অঞ্চল বা কোনো অবকাঠামোতত্ত্বসমৃদ্ধ জায়গা বলছেন।
- আবার অনেকে প্রতীকী ব্যাখ্যা দেন, অর্থাৎ ইয়াজুজ-মাজুজ প্রকৃতপক্ষে ভয়াবহ শক্তি বা বিপদকে বোঝায়, যা কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়।
ইয়াজুজ-মাজুজ ও কিয়ামতের আলামত
ইসলামী এস্ক্যাটোলজিতে ইয়াজুজ-মাজুজের মুক্তি কিয়ামতের বড় আলামত হিসেবে বিবেচিত।
হাদীসে বর্ণিত আছে, দাজ্জাল, ইমাম মাহদী ও ইসা (আ.)’র আগমন পর ইয়াজুজ-মাজুজ মুক্তি পাবে। মুক্তির পর তারা পৃথিবীতে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। তাদের ধ্বংসের পর পৃথিবীতে সাময়িক শান্তি আসবে, এবং তারপর আসবে কিয়ামত।
তাই ইয়াজুজ-মাজুজের ব্যাপারে সচেতন থাকা, কুরআন ও হাদীস থেকে সঠিক জ্ঞান গ্রহণ করা মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
ইয়াজুজ ও মাজুজ ইসলামের অন্তকাল বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ রহস্যময় জাতি। তাদের উদ্ভব, ধ্বংসযজ্ঞ, এবং কিয়ামতের পূর্ববর্তী অবস্থা কুরআন ও হাদীসের আলোকে সুস্পষ্ট।
তাদের ধ্বংস হবে আল্লাহর বিশেষ হস্তক্ষেপে, যা মানবজাতির এক কঠিন পরীক্ষা। আধুনিক যুগেও এই বিষয় নিয়ে নানা গবেষণা, মতামত ও বিতর্ক চলছে।
মুসলিমরা উচিত বিভ্রান্ত না হয়ে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা এবং কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে সতর্ক থাকা।
ট্যাগসমূহ: ইয়াজুজমাজুজ, যুলকারনাইন, কিয়ামতের আলামত, ইসলামিক এস্ক্যাটোলজি, কুরআন, হাদীস, তাফসির, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
আরো পড়ুন: ইসলামিক লেবেল সংক্রান্ত অন্যান্য পোস্ট
আরও বিস্তারিত জানতে: IslamQA – ইয়াজুজ-মাজুজ