২০২৫‑২৬ সালের জাতীয় বাজেট: দেশের অর্থনীতি ও জনগণের প্রত্যাশা

জাতীয় বাজেট বাজেট বিশ্লেষণ বাংলাদেশ অর্থনীতি সরকারি অর্থনীতি

Table of Contents

 

জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬ সালের: দেশের অর্থনীতি ও জনগণের প্রত্যাশা এক বিস্তৃত বিশ্লেষণ

 

আসসালামু আলাইকুম। একজন বাংলাদেশী মুসলিম ব্লগার হিসেবে, দেশের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করা আমার অন্যতম প্রিয় বিষয়। আজকের এই পোস্টে আমরা জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬ সালের: দেশের অর্থনীতি ও জনগণের প্রত্যাশা — এই বিস্তৃত বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। এই জাতীয় বাজেট শুধু একটি আর্থিক পরিকল্পনা নয়, বরং এটি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের আগামী দিনের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক। সরকার এই জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আদায়, ব্যয়, সামাজিক সুরক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জনগণের প্রত্যাশা – সবকিছুকে সমন্বয় করে একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।

এই জাতীয় বাজেট দেশের অর্থনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করবে, এর সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলো কী কী, এবং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা কী প্রত্যাশা করতে পারি – এই সবকিছুই আমরা এই পোস্টে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করব। আশা করি, এই আলোচনা আপনাদের কাছে তথ্যপূর্ণ এবং সহায়ক হবে।


ভূমিকা: একটি সাহসী পদক্ষেপ ভবিষ্যতের দিকে

প্রতি বছর জাতীয় বাজেট আসে নতুন আশা আর চ্যালেঞ্জ নিয়ে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ও এর ব্যতিক্রম নয়। এটি বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন যাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বর্তমান সরকারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ ভিশন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এই জাতীয় বাজেটে ডিজিটাল রূপান্তর, উদ্ভাবন এবং পরিবেশ সুরক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।

এই বাজেটের মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। বিশাল অঙ্কের এই বাজেট কীভাবে দেশের বিভিন্ন খাতকে প্রভাবিত করবে, তা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। বিশেষ করে, দেশের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা, ব্যয়ের খাতসমূহ, এবং অর্থায়নের উৎসগুলো বাজেট সফল হওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


১. জাতীয় বাজেটের আয় ও অর্থায়ন: অর্থের জোগান কোথায় থেকে আসবে?

একটি বাজেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর আয় এবং অর্থায়ন পরিকল্পনা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট আয় ধরা হয়েছে ৫.৬ ট্রিলিয়ন টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে আসবে এবং কীভাবে এর জোগান দেওয়া হবে, তা বোঝা অত্যন্ত জরুরি।

ক. আয়ের প্রধান উৎসসমূহ

আমাদের দেশের আয়ের প্রধান উৎস হলো কর রাজস্ব, যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) থেকে ৪.৩৫ ট্রিলিয়ন টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। কর রাজস্বের পাশাপাশি, অন্যান্য উৎস থেকেও আয় আসবে:

  • অ-কর রাজস্ব: এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের লভ্যাংশ, বিভিন্ন সেবার ফি, এবং জরিমানা থেকে প্রাপ্ত অর্থ অন্তর্ভুক্ত।
  • বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান: উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা থেকে প্রাপ্ত ঋণ ও অনুদান বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করে। এই উৎসগুলো সাধারণত বড় অবকাঠামো প্রকল্প এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে ব্যবহার করা হয়।
  • স্থানীয় ঋণ: যখন বৈদেশিক উৎস থেকে পর্যাপ্ত অর্থায়ন পাওয়া যায় না বা সরকারের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেশি থাকে, তখন স্থানীয় উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হয়। এর মধ্যে ব্যাংক খাত (যেমন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক) এবং অ-ব্যাংক খাত (যেমন সঞ্চয়পত্র বিক্রয়) প্রধান।

খ. বাজেট ঘাটতি ও এর অর্থায়ন

এই জাতীয় বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৪.৫%। বাজেট ঘাটতি হলো সরকারের প্রত্যাশিত ব্যয় এবং প্রত্যাশিত আয়ের মধ্যে পার্থক্য। এই ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার মূলত অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করে।

  • অভ্যন্তরীণ ঋণ: সাধারণত সরকার ব্যাংক ও অ-ব্যাংকিং খাত (যেমন সঞ্চয়পত্র) থেকে ঋণ নেয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা অনেক সময় মুদ্রাস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিতে পারে। অন্যদিকে, সঞ্চয়পত্র সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ঋণ সংগ্রহের একটি মাধ্যম, যা সরকারের ঋণের বোঝা কিছুটা বাড়ালেও তারল্য ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে।
  • বৈদেশিক ঋণ: বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB), আইএমএফ (IMF) এবং বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক অংশীদারদের কাছ থেকে সরকার বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে। এই ঋণগুলো সাধারণত কম সুদে এবং দীর্ঘমেয়াদী হয়, তবে এর সাথে বিভিন্ন শর্তও যুক্ত থাকে।

বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ অতিরিক্ত ঋণ ভবিষ্যতের জন্য বোঝা তৈরি করতে পারে। তবে, যদি এই ঋণ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে তা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে।


২. করনীতি ও কর কাঠামো: স্বচ্ছতা ও আধুনিকায়নের পথে

একটি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে করনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০২৫-২৬ সালের জাতীয় বাজেটে করনীতি এবং কর কাঠামোতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা আধুনিকায়ন ও স্বচ্ছতার ওপর জোর দেয়।

ক. নতুন কর সংস্কার ও করমুক্ত সীমা

এই জাতীয় বাজেটে করমুক্ত সীমা ৩.৭৫ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি সাধারণ জনগণের ওপর করের বোঝা কিছুটা কমাতে সাহায্য করবে এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য কিছুটা স্বস্তি বয়ে আনবে। তবে, মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান হারের পরিপ্রেক্ষিতে এই সীমা আরও বাড়ানোর দাবি থেকে যায়।

এছাড়াও, নতুন কর সংস্কারের আওতায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে:

  • ই-টিআইএন (E-TIN) বাধ্যতামূলক: কর প্রদানের প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও স্বচ্ছ করতে ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে কর শনাক্তকরণ এবং রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড হবে। এটি করদাতাদের জন্য সুবিধাজনক হবে এবং কর ফাঁকি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
  • ডেটা অ্যানালিটিক্স ব্যবহারে কর ফাঁকি রোধ: কর ফাঁকি রোধে ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে। এর মাধ্যমে করদাতাদের আর্থিক লেনদেন এবং সম্পদের তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য কর ফাঁকি শনাক্ত করা সহজ হবে। এটি কর প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে এবং করের ভিত্তি সম্প্রসারিত করবে।
  • স্মার্ট এনবিআর প্রতিষ্ঠা: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (NBR) একটি ‘স্মার্ট এনবিআর’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো, এনবিআরকে আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত ডেটা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, এবং দক্ষ জনবল দ্বারা সজ্জিত করা হবে, যাতে কর আদায় প্রক্রিয়া আরও কার্যকর ও স্বচ্ছ হয়।
  • স্টার্টআপ কর ছাড়: ৫ বছর: তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে এবং নতুন ব্যবসা সৃষ্টির ধারা বজায় রাখতে স্টার্টআপগুলোর জন্য ৫ বছরের কর ছাড় ঘোষণা করা হয়েছে। এটি উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নতুন গতি আনবে। এই ছাড় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও সহায়ক হবে।

খ. কর কাঠামোর সুফল ও চ্যালেঞ্জ

এই কর সংস্কারগুলো দেশের কর আদায় প্রক্রিয়াকে আরও আধুনিক, স্বচ্ছ এবং কার্যকর করতে সাহায্য করবে। এর ফলে করের ভিত্তি বাড়বে এবং সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। তবে, এই সংস্কারগুলোর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করবে এনবিআর-এর সক্ষমতা, জনসচেতনতা, এবং দুর্নীতির অনুপস্থিতির ওপর। কর ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের ব্যবহার কর ফাঁকি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, তবে এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার।


৩. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে সরকার

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সমাজের পিছিয়ে পড়া এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরাসরি সহায়তা করে। ২০২৫-২৬ সালের জাতীয় বাজেটে মোট বাজেটের ১৮% সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে, যা সরকারের জনকল্যাণমুখী মনোভাবের পরিচায়ক।

ক. প্রধান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসমূহ

এই খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছানো হবে:

  • বয়স্ক/বিধবা/প্রতিবন্ধী ভাতা: বয়স্ক ব্যক্তি, বিধবা নারী এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবন নির্বাহে সহায়তা করার জন্য এই ভাতা প্রদান করা হয়। এই কর্মসূচির আওতায় মাসিক ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এর পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে আরও বেশি সংখ্যক দুস্থ মানুষ এর সুবিধা পায়।
  • মাতৃত্বকালীন ভাতা: গর্ভবতী মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং পুষ্টি নিশ্চিত করতে মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়া হয়। এই ভাতা মা ও শিশুদের মৃত্যুর হার কমাতে এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে উৎসাহিত করে।
  • ‘ই-ভাউচার’ চালু: সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগীদের কাছে অর্থ পৌঁছানোর প্রক্রিয়াকে আরও সহজ, স্বচ্ছ এবং কার্যকর করতে ‘ই-ভাউচার’ পদ্ধতি চালু করা হবে। এর মাধ্যমে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভাতার অর্থ সরাসরি সুবিধাভোগীদের অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যাবে, যা দুর্নীতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাবে।
  • ঘর নির্মাণ প্রকল্প: ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য আবাসন নিশ্চিত করতে ঘর নির্মাণ প্রকল্পগুলো অব্যাহত থাকবে। এই প্রকল্পগুলো দরিদ্র মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত করে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে।
  • প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বৃদ্ধি: মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ফলে প্রসূতি সেবা, শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যা, এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির মান উন্নত হবে।

খ. সামাজিক সুরক্ষার গুরুত্ব ও চ্যালেঞ্জ

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো দারিদ্র্য বিমোচন, অসমতা হ্রাস, এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অপরিহার্য। এটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতা বাড়িয়ে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সহায়তা করে। তবে, এই কর্মসূচিগুলোর সফল বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • সুবিধাভোগী নির্বাচন: প্রকৃত সুবিধাভোগীদের সঠিকভাবে নির্বাচন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যাতে অযোগ্য ব্যক্তিরা সুবিধা নিতে না পারে।
  • বাজেটের সঠিক ব্যবহার: বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং অপচয় রোধ করাও গুরুত্বপূর্ণ।
  • মনিটরিং ও জবাবদিহিতা: কর্মসূচির নিয়মিত মনিটরিং এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে এর সুফল প্রকৃত অর্থে জনগণের কাছে পৌঁছায়।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে আরও কার্যকর করা সম্ভব হলে, তা দেশের টেকসই উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে।


৪. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত: মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ

একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার মানবসম্পদের ওপর। আর মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। ২০২৫-২৬ সালের জাতীয় বাজেটে এই দুটি খাতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

ক. শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ও অগ্রাধিকার

শিক্ষা খাতে ৯৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বিশাল বিনিয়োগ। এই বরাদ্দের মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার মান উন্নত করা এবং শিক্ষার্থীদেরকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করা।

অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে:

  • কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষা: দেশের ক্রমবর্ধমান শিল্প ও সেবা খাতের চাহিদা মেটাতে কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। নতুন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন, বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিকায়ন, এবং কারিগরি শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। এর মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
  • অনলাইন শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়ন: কোভিড-১৯ মহামারীর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগের প্রসার, ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি, এবং শিক্ষকদের অনলাইন শিক্ষায় প্রশিক্ষণ – এই বিষয়গুলোতে বিনিয়োগ করা হবে। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাকে আরও সহজলভ্য করবে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
  • শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন: শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ওপর জোর দেওয়া হবে। উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদেরকে আরও কার্যকরভাবে শিক্ষা দিতে পারবেন, যা শিক্ষার সামগ্রিক মানকে উন্নত করবে।

খ. স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ও অগ্রাধিকার

স্বাস্থ্য খাতে ৪৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মৌলিক স্বাস্থ্য চাহিদা পূরণ এবং উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান এই খাতের মূল লক্ষ্য।

জোর দেওয়া হয়েছে:

  • মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য: মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এই খাতের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে এবং নবজাতকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবার মান উন্নয়ন এবং শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সম্প্রসারণ।
  • কমিউনিটি ক্লিনিক বিস্তার: গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর বিস্তার ও আধুনিকায়নে বিনিয়োগ করা হবে। এই ক্লিনিকগুলো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, জরুরি চিকিৎসা এবং ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
  • রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ: অসংক্রামক রোগ (যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ) এবং সংক্রামক রোগ (যেমন ডেঙ্গু, যক্ষ্মা) প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে উৎসাহিত করার ওপরও জোর দেওয়া হবে।
  • স্বাস্থ্য গবেষণায় বিনিয়োগ: নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ও ঔষধ আবিষ্কারের জন্য স্বাস্থ্য গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হবে। এর ফলে দেশের স্বাস্থ্য খাত আরও স্বাবলম্বী হবে এবং উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এই বিনিয়োগ মানবসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।


৫. অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিবহন: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মেরুদণ্ড

যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শক্তিশালী অবকাঠামো অপরিহার্য। ২০২৫-২৬ সালের জাতীয় বাজেটে অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিবহন খাতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, যা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ত্বরান্বিত করবে।

ক. প্রধান অবকাঠামো প্রকল্পসমূহ

এই জাতীয় বাজেটে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে এবং নতুন কিছু প্রকল্প শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে:

  • পদ্মা রেল সংযোগ: পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প। এটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার রেল যোগাযোগ স্থাপন করবে। এর ফলে পণ্য পরিবহন সহজ হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে, এবং জনগণের যাতায়াত আরও দ্রুত ও সুবিধাজনক হবে। এটি দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
  • ঢাকা ইস্টার্ন বাইপাস: ঢাকার যানজট নিরসনে এবং শহরকে আরও বাসযোগ্য করতে ঢাকা ইস্টার্ন বাইপাস নির্মাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এটি শহরের বাইরে দিয়ে একটি নতুন রুট তৈরি করবে, যা দূরপাল্লার যানবাহনগুলোকে শহরের মূল অংশে প্রবেশ না করেই গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। এর ফলে পরিবহন খরচ কমবে এবং সময় বাঁচবে।
  • উড়ালপথ ও সাবওয়ে: শহরগুলোতে যানজট কমাতে এবং গণপরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নত করতে নতুন উড়ালপথ ও সাবওয়ে (পাতাল রেল) প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করা হবে। বিশেষ করে, ঢাকার মেট্রো রেল প্রকল্পের সম্প্রসারণ এবং নতুন সাবওয়ে রুটের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। এর ফলে নগরীর পরিবহন ব্যবস্থা আরও আধুনিক ও কার্যকর হবে।
  • স্মার্ট নগরায়ণ পরিকল্পনা: দেশের শহরগুলোকে আধুনিক ও বাসযোগ্য করে তুলতে ‘স্মার্ট নগরায়ণ’ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, আধুনিক বিদ্যুৎ সরবরাহ, এবং ডিজিটাল সেবা নিশ্চিত করা। এটি নগরবাসীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং শহুরে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে।
  • নদীপথ ও বন্দর উন্নয়ন: দেশের নদীপথগুলোকে আরও কার্যকর করতে ড্রেজিং এবং নতুন জেটি নির্মাণে বিনিয়োগ করা হবে। চট্টগ্রাম বন্দর, মোংলা বন্দর এবং পায়রা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও জোর দেওয়া হবে। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সহজ করবে এবং পণ্য পরিবহনের খরচ কমাবে।
  • বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস (যেমন সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ) উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হবে। এটি দেশের শিল্পায়নকে সমর্থন করবে এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।

খ. অবকাঠামো উন্নয়নের সুফল ও চ্যালেঞ্জ

এই অবকাঠামো প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত করবে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে চাঙ্গা করবে।

তবে, এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব: বড় প্রকল্পগুলো প্রায়শই সময়মতো শেষ হয় না, যার ফলে ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
  • স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে দুর্নীতির সুযোগ না থাকে।
  • ভূমি অধিগ্রহণ: ভূমি অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন একটি সংবেদনশীল বিষয়, যা দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে সমাধান করা প্রয়োজন।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারলে, অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মানচিত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।


৬. কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা: সবুজ ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। ২০২৫-২৬ সালের জাতীয় বাজেটে কৃষিখাতে ৩৭,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষকদের জীবনমান উন্নয়ন, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক হবে।

ক. কৃষি খাতের অগ্রাধিকার ও প্রকল্পসমূহ

এই বাজেটে কৃষিখাতকে আধুনিকীকরণ এবং কৃষকদেরকে আরও শক্তিশালী করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে:

  • স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি: কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যাকে ‘স্মার্ট কৃষি’ বলা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, ড্রোন ব্যবহার করে ফসলের পর্যবেক্ষণ, এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে কৃষকদের কাছে কৃষি তথ্য পৌঁছে দেওয়া। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে এবং ফসলের অপচয় কমবে।
  • সার ও বীজে ভর্তুকি: কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমাতে এবং ফসলের উৎপাদন বাড়াতে সার ও বীজে ভর্তুকি অব্যাহত থাকবে। এটি কৃষকদের জন্য একটি বড় স্বস্তি এবং খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহ জোগাবে।
  • কৃষি যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করা: কৃষকদের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা এবং ঋণ সুবিধা প্রদান করা হবে। ছোট ও মাঝারি কৃষকদের কাছে সুলভে কৃষি যন্ত্রপাতি পৌঁছে দেওয়া হলে সময় ও শ্রমের সাশ্রয় হবে এবং উৎপাদন খরচ কমবে।
  • দুর্যোগে কৃষক পুনর্বাসন তহবিল: বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা ইত্যাদির কারণে কৃষকরা প্রায়শই ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই জাতীয় বাজেটে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি কৃষকদেরকে দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে।
  • ফসল বহুমুখীকরণ: ধান উৎপাদনের পাশাপাশি উচ্চমূল্যের ফসল (যেমন ফল, শাকসবজি, মশলা) এবং মাছ ও পশুপালনের ওপর জোর দেওয়া হবে। এতে কৃষকদের আয় বাড়বে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা আরও জোরদার হবে।
  • কৃষি ঋণ সুবিধা: কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে এবং কম সুদে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। এতে কৃষকরা প্রয়োজনীয় পুঁজি সংগ্রহ করে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে পারবেন।

খ. খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

কৃষি খাতের এই বিনিয়োগ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাবে। এটি দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতেও সাহায্য করবে।

তবে, এই খাতে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি কৃষকদের জন্য একটি বড় হুমকি। এই প্রভাব মোকাবিলায় টেকসই কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি।
  • বাজারজাতকরণ: কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে এবং বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করতে হবে।
  • কৃষি জমির হ্রাস: নগরায়ণ এবং শিল্পায়নের কারণে কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, যা খাদ্য উৎপাদনে একটি দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে কৃষিখাতকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব হলে, তা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখবে।


৭. শিল্প ও বিনিয়োগ উন্নয়ন: প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে শিল্পায়ন এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ অপরিহার্য। ২০২৫-২৬ সালের জাতীয় বাজেটে শিল্প ও বিনিয়োগ উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রফতানি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

ক. বিনিয়োগ আকর্ষণ ও শিল্প উন্নয়নে পদক্ষেপ

সরকার দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে:

  • বিদেশি বিনিয়োগে করছাড়: ১০ বছর: বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন শিল্প খাতে ১০ বছরের জন্য করছাড়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বড় প্রণোদনা হবে এবং বাংলাদেশে নতুন শিল্প স্থাপনকে উৎসাহিত করবে। এর ফলে প্রযুক্তি হস্তান্তর হবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
  • বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি লিজ: বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে (SEZ) জমি লিজের প্রক্রিয়া সহজ করা হবে। এই অঞ্চলগুলোতে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সব ধরনের আধুনিক অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করা হবে, যা বিনিয়োগের পরিবেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে।
  • ওয়ান-স্টপ সার্ভিস পোর্টাল উন্নয়ন: বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভিন্ন সরকারি সেবা (যেমন লাইসেন্স প্রাপ্তি, নিবন্ধন) সহজ ও দ্রুত করতে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস পোর্টাল আরও উন্নত করা হবে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা সহজেই প্রয়োজনীয় অনুমতি নিতে পারবেন, যা ব্যবসা শুরু ও পরিচালনার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করবে।
  • ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সহায়তা: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) খাতকে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয়। এই খাতে ঋণ সুবিধা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত সহায়তা, এবং বাজারজাতকরণে সহায়তা প্রদান করা হবে। SME খাতের উন্নয়নে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।
  • রফতানি বহুমুখীকরণ: তৈরি পোশাক শিল্পের পাশাপাশি চামড়া, ঔষধ, কৃষি পণ্য, এবং আইটি সেবার মতো নতুন রফতানি খাতগুলোকে উৎসাহিত করা হবে। নতুন পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে এবং রফতানি আয় বাড়াবে।
  • শিল্প কারখানায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি: শিল্প কারখানাগুলোতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হবে। এর ফলে শিল্প বর্জ্য হ্রাস পাবে এবং পরিবেশ দূষণ কমবে, যা টেকসই শিল্প উন্নয়নে সহায়ক হবে।

খ. বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

এই পদক্ষেপগুলো দেশের শিল্পায়ন এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।

তবে, কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:

  • অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা: উন্নত অবকাঠামোর অভাব, বিশেষ করে গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি বাধা।
  • আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি: স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: বিভিন্ন সরকারি অনুমোদনের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিনিয়োগের গতিকে কমিয়ে দিতে পারে।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সরকার যদি একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তাহলে দেশের শিল্প খাত আরও শক্তিশালী হবে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে।


৮. তথ্যপ্রযুক্তি ও উদ্ভাবন: ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ এর ভিত্তি

‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ ভিশন বাস্তবায়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) ও উদ্ভাবন খাতকে এই বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল রূপান্তর এবং প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ক. ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ

তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে আরও শক্তিশালী করতে এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোকে উৎসাহিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে:

  • ই-গভর্নেন্স: সরকারি সেবাগুলোকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা হবে, যাতে জনগণ সহজে এবং দ্রুত সেবা গ্রহণ করতে পারে। জন্ম নিবন্ধন, পাসপোর্ট আবেদন, কর পরিশোধ, এবং অন্যান্য সরকারি সেবা অনলাইনে পাওয়া যাবে। এর ফলে সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বাড়বে এবং দুর্নীতি কমবে।
  • AI ও রোবটিক্স গবেষণা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং রোবটিক্স গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য তহবিল সরবরাহ করা হবে। এটি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়তা করবে এবং দেশের শিল্প খাতকে আধুনিকায়ন করবে।
  • স্টার্টআপ ইনকিউবেটর: তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী ধারণাগুলোকে বাস্তব রূপ দিতে স্টার্টআপ ইনকিউবেটর এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডের মাধ্যমে সহায়তা করা হবে। এর ফলে নতুন ব্যবসা তৈরি হবে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নতুন গতি আনবে।
  • ডিজিটাল দক্ষতা উন্নয়ন: দেশের জনগণকে ডিজিটাল শিক্ষায় শিক্ষিত করতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মকে কোডিং, ডেটা অ্যানালিটিক্স, এবং সাইবার সুরক্ষার মতো বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে উৎসাহিত করা হবে।
  • সাইবার নিরাপত্তা: ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল লেনদেন এবং অনলাইন কার্যক্রমের কারণে সাইবার নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাইবার হামলা থেকে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে সাইবার নিরাপত্তা অবকাঠামো শক্তিশালী করা হবে এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো হবে।
  • ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সম্প্রসারণ: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দ্রুত গতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে দেওয়া হবে। এটি অনলাইন শিক্ষা, ই-কমার্স, এবং ডিজিটাল সেবার প্রসারে সহায়ক হবে।

খ. ডিজিটাল বিপ্লবের সুফল ও চ্যালেঞ্জ

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এই বিনিয়োগ দেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করবে এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবে। এটি দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানকে উন্নত করবে।

তবে, এই খাতে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:

  • ডিজিটাল বিভাজন: শহর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল সুবিধার অসমতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সকলের কাছে প্রযুক্তির সুবিধা পৌঁছে দেওয়া জরুরি।
  • মানবসম্পদের অভাব: আইটি খাতে দক্ষ জনবলের অভাব একটি বড় বাধা। এ খাতে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করা প্রয়োজন।
  • সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি: ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল নির্ভরতার সাথে সাথে সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়ছে, যা মোকাবিলায় আরও বিনিয়োগ ও সচেতনতা প্রয়োজন।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব হলে, তা দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন বিপ্লব ঘটাবে।


৯. জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ: টেকসই ভবিষ্যতের অঙ্গীকার

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতি ও জনগণের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০২৫-২৬ সালের জাতীয় বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

ক. জলবায়ু ও পরিবেশ সুরক্ষায় পদক্ষেপ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে:

  • জলবায়ু তহবিল গঠন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা এবং অভিযোজন ও প্রশমন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশেষ জলবায়ু তহবিল গঠন করা হবে। এই তহবিল স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা করবে।
  • গ্রিন এনার্জি উন্নয়ন: নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস (যেমন সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি) উৎপাদনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হবে। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ কমবে এবং পরিবেশ দূষণ হ্রাস পাবে।
  • বনভূমি সংরক্ষণ ও বনায়ন: বনভূমি সংরক্ষণ এবং নতুন বনায়ন কর্মসূচিতে জোর দেওয়া হবে। গাছ লাগানোর মাধ্যমে কার্বন শোষণ বৃদ্ধি পাবে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে। উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনায়ন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সহায়ক হবে।
  • আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: শহর ও গ্রামে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে বর্জ্য পৃথকীকরণ, রিসাইক্লিং, এবং বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন। এটি পরিবেশ দূষণ কমাবে এবং স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
  • নদী দূষণ রোধ: দেশের নদীগুলো দূষণমুক্ত করতে এবং নদীর নাব্যতা বজায় রাখতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। শিল্প বর্জ্য এবং পয়ঃনিষ্কাশন বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
  • পরিবেশবান্ধব পরিবহন: গণপরিবহন ব্যবস্থায় পরিবেশবান্ধব যানবাহনের ব্যবহার বাড়ানো হবে। ইলেকট্রিক যানবাহন এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি চালিত যানবাহনের ব্যবহার উৎসাহিত করা হবে।

খ. পরিবেশ সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষায় এই বিনিয়োগ দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা এবং জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অপরিহার্য। এটি বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় আরও সক্ষম করে তুলবে।

তবে, এই খাতে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:

  • অর্থায়নের উৎস: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশাল অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন, যার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদের সঠিক ব্যবহার জরুরি।
  • জনসচেতনতা: পরিবেশ সুরক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণ এবং সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • নীতি ও আইনের বাস্তবায়ন: পরিবেশ সুরক্ষা সম্পর্কিত নীতি ও আইনগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সরকার যদি পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ একটি টেকসই এবং সবুজ ভবিষ্যৎ গড়ার পথে এগিয়ে যাবে।


১০. চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ: স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা ও সমাধান

২০২৫-২৬ সালের জাতীয় বাজেট একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নে বিশাল সম্ভাবনা রাখে। তবে, এই জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যা মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরি।

ক. প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ

  • স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব: বাজেটের অর্থ ব্যয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি ও অনিয়ম বাজেটের সুফলকে ব্যাহত করতে পারে।
  • প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব: প্রায়শই সরকারি প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ হয় না, যার ফলে ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
  • অকার্যকর ব্যয়: অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় বা অদক্ষ খাতে ব্যয় হয়, যা সম্পদের অপচয় ঘটায়। বাজেটের প্রতিটি টাকা যেন কার্যকরভাবে ব্যয় হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
  • রাজস্ব ঘাটতি ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) থেকে ৪.৩৫ ট্রিলিয়ন টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বিশাল লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে। রাজস্ব আদায় কম হলে জাতীয় বাজেট ঘাটতি আরও বাড়তে পারে।
  • মুদ্রাস্ফীতি: ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বাজেট বাস্তবায়নের সময় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
  • বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ এবং ডলারের বিনিময় হার অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
  • ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা: খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি ঝুঁকি।
  • দক্ষ জনবলের অভাব: বিভিন্ন খাতের উন্নয়নে দক্ষ জনবলের অভাব একটি বড় বাধা।

খ. সুপারিশসমূহ

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এবং জাতীয় বাজেটের সফল বাস্তবায়নে নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:

  • নিরীক্ষা ও মনিটরিং জোরদার: জাতীয় বাজেটের প্রতিটি খাতের ব্যয় নিরীক্ষা এবং কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা উচিত, যাতে দুর্নীতির সুযোগ না থাকে এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। স্বাধীন নিরীক্ষা সংস্থাগুলোকে আরও শক্তিশালী করা উচিত।
  • বাস্তব ভিত্তিক প্রকল্প পরিকল্পনা: প্রকল্প গ্রহণ করার আগে সেগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই এবং বাস্তবতার নিরিখে পরিকল্পনা করা উচিত। মেগা প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ করার জন্য কঠোর সময়সীমা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা উচিত।
  • জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি: জাতীয় বাজেটট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ এবং মতামত গ্রহণের সুযোগ তৈরি করা উচিত। এতে জাতীয় বাজেট আরও জনমুখী হবে এবং জনগণের চাহিদা প্রতিফলিত হবে।
  • কর আদায় ব্যবস্থার আধুনিকায়ন: কর ফাঁকি রোধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এবং কর আদায় প্রক্রিয়াকে আরও আধুনিক ও ডিজিটাল করা উচিত। করের ভিত্তি সম্প্রসারণের জন্য নতুন করদাতা খুঁজে বের করা এবং তাদের করদানে উৎসাহিত করা জরুরি।
  • অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা: আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা উচিত। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
  • মানবসম্পদ উন্নয়ন: শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আরও জোর দেওয়া উচিত, যাতে দক্ষ জনবল তৈরি হয় এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়।
  • মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনা উন্নত করা এবং কালোবাজারি রোধ করা জরুরি।
  • বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি: রফতানি বৃদ্ধি এবং অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

এই সুপারিশগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে, ২০২৫-২৬ সালের জাতীয় বাজেট দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হতে পারে।


১১. উপসংহার: একটি সাহসী ও ভবিষ্যত-মুখী পদক্ষেপ

২০২৫-২৬ সালের জাতীয় বাজেট নিঃসন্দেহে একটি সাহসী এবং ভবিষ্যত-মুখী পদক্ষেপ। এই জাতীয় বাজেট ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ ভিশন বাস্তবায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশাল অঙ্কের এই বাজেট দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রেখে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার, কর্মসংস্থান সৃষ্টির, এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রদান করে।

আমরা দেখেছি, এই জাতীয় বাজেটে মানবসম্পদ উন্নয়ন (শিক্ষা ও স্বাস্থ্য), অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্প ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, তথ্যপ্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা – প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ খাতেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিশেষ করে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ১৮% বরাদ্দ এবং স্টার্টআপগুলোর জন্য ৫ বছরের কর ছাড় তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন আশার সঞ্চার করবে।

তবে, এই জাতীয় বাজেটের সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করবে এর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, এবং কার্যকর মনিটরিংয়ের ওপর। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব রোধ করা, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা, এবং অকার্যকর ব্যয় পরিহার করা – এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা অত্যাবশ্যক। যদি সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে, তাহলে এই বাজেট কেবল একটি আর্থিক দলিল না হয়ে, আমাদের সকলের স্বপ্ন পূরণের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠবে।

একজন ব্লগার হিসেবে, আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সকলেরই উচিত এই জাতীয় বাজেট  সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং এর ইতিবাচক বাস্তবায়নে সরকারকে সহায়তা করা। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং গঠনমূলক সমালোচনা একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আপনার মতামত আমাদের জানাতে ভুলবেন না। এই বাজেট নিয়ে আপনার ভাবনা কী? দৃষ্টি আকর্ষণকারী বিশ্লেষণ শেয়ার করুন নিচের মন্তব্যে।

জাতীয় বাজেট সম্পর্কিত আরও খবর পড়ুন

জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬ সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইটের লিঙ্কসমূহ

এখানে উল্লেখ করা লিঙ্কগুলো আপনাকে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য, বিশ্লেষণ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন খুঁজে পেতে সাহায্য করবে:

প্রাথমিক সরকারি উৎস:

নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম ও বিশ্লেষণধর্মী পোর্টাল:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *