পিআর পদ্ধতি: জনপ্রতিনিধিত্বের এক বিকল্প ধারা 🗳️

পিআর বা portional Representation (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি হলো এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা, যেখানে একটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের সঙ্গে সংসদে তাদের আসনের সংখ্যা আনুপাতিক হারে নির্ধারিত হয়। এর মানে হলো, যদি একটি দল মোট ভোটের ২০% পায়, তবে তারা সংসদীয় আসনের প্রায় ২০% পাবে। এই পদ্ধতিটি প্রচলিত ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ (First-Past-the-Post – FPTP) বা ‘যে সর্বাধিক ভোট পাবে সেই নির্বাচিত হবে’ পদ্ধতির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, যেখানে শুধু সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই নির্বাচিত হন, এমনকি যদি তিনি মোট ভোটের ৫০% এর কম পেয়ে থাকেন।
পিআর পদ্ধতির উদ্দেশ্য 🎯
পিআর পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো নির্বাচনী ফলাফলে জনগণের ইচ্ছার সঠিক প্রতিফলন ঘটানো। এটি নিশ্চিত করে যে প্রতিটি ভোটই মূল্যবান এবং কোনো দলের ভোটই বৃথা যায় না, এমনকি যদি তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারে। এর ফলে ছোট দলগুলোও সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারে এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের মতামত সংসদে উঠে আসে। এটি গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রতিনিধিত্বমূলক করে তোলে।
পিআর পদ্ধতির প্রকারভেদ 📚
পিআর পদ্ধতির বিভিন্ন রূপ রয়েছে, যার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হলো:
- পার্টি-লিস্ট পিআর (Party-List PR): এটি সবচেয়ে সাধারণ পিআর পদ্ধতি। এখানে ভোটাররা কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নয়, বরং একটি রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন। দলগুলো তাদের প্রার্থীদের একটি তালিকা (list) প্রকাশ করে এবং প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে সেই তালিকা থেকে প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। এই পদ্ধতিটি আরও দুই প্রকারের হতে পারে:
- ক্লোজড লিস্ট (Closed List): এখানে ভোটারদের তালিকার প্রার্থীদের ক্রম পরিবর্তনের কোনো সুযোগ থাকে না। দল যে ক্রম ঠিক করে, সেই ক্রমেই প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। এটি দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে, তবে ভোটারদের পছন্দের স্বাধীনতা সীমিত করে।
- ওপেন লিস্ট (Open List): ভোটাররা নির্দিষ্ট একজন প্রার্থীকে বা তাদের পছন্দের ক্রম অনুসারে প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেন, যা দলের অভ্যন্তরীণ ক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে। এটি ভোটারদের প্রার্থীর উপর আরও নিয়ন্ত্রণ দেয় এবং জনপ্রিয় প্রার্থীদের তালিকা থেকে উপরে উঠতে সাহায্য করে।
- মিক্সড মেম্বার প্রportional Representation (MMPR) বা মিশ্র-সদস্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব: এটি ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট এবং পার্টি-লিস্ট পিআর পদ্ধতির একটি সংমিশ্রণ। এখানে ভোটাররা দুটি ভোট দেন – একটি নির্দিষ্ট প্রার্থীকে (যেমন FPTP-তে) এবং অন্যটি একটি দলকে (যেমন পার্টি-লিস্ট পিআর-এ)। কিছু আসন সরাসরি নির্বাচিত প্রার্থীর মাধ্যমে পূরণ হয় এবং বাকি আসনগুলো দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে পূরণ হয়, যাতে সামগ্রিকভাবে আনুপাতিক ফলাফল নিশ্চিত হয়। জার্মানি এবং নিউজিল্যান্ডে এই পদ্ধতি প্রচলিত। এটি স্থিতিশীল সরকার এবং ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব উভয়ই নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
- সিংগেল ট্রান্সফারেবল ভোট (Single Transferable Vote – STV): এটি একটি জটিল কিন্তু অত্যন্ত আনুপাতিক পদ্ধতি, যা মাল্টি-মেম্বার বা একাধিক সদস্যের নির্বাচনী এলাকায় ব্যবহৃত হয়। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ১, ২, ৩, ইত্যাদি নম্বরের মাধ্যমে ক্রম অনুসারে ভোট দেন। যদি কোনো প্রার্থী যথেষ্ট ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন, তবে তার অতিরিক্ত ভোট অন্য প্রার্থীদের কাছে স্থানান্তরিত হয়। যদি কোনো প্রার্থী নির্বাচিত না হন, তবে তার সর্বনিম্ন ভোট অন্য প্রার্থীদের কাছে স্থানান্তরিত হয়। এটি নিশ্চিত করে যে কোনো ভোটই নষ্ট হয় না এবং প্রতিটি ভোটার তার পছন্দের একজন প্রার্থীকে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখতে পান। আয়ারল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু নির্বাচনে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এটি ভোটারদের পছন্দের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা প্রদান করে।
- অ্যাপোরশনমেন্ট (Apportionment): এটি একটি পদ্ধতি যেখানে মোট আসন সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করা হয়। এটি সরাসরি একটি নির্বাচনী পদ্ধতি নয়, বরং আসনের বিতরণ পদ্ধতি। এটি মূলত ফেডারেল কাঠামোর দেশগুলোতে ব্যবহৃত হয় যেখানে জনসংখ্যার ভিন্নতা অনুযায়ী আসন বন্টন করা হয়।
পিআর পদ্ধতির অপরিমেয় উপকারীতা: বাংলাদেশের জন্য কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ? 🇧🇩
পিআর পদ্ধতির অসংখ্য সুবিধা রয়েছে, যা বাংলাদেশকে একটি আরও স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই পদ্ধতির মূল ফোকাস হলো জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং প্রত্যেক ভোটের মূল্য প্রতিষ্ঠিত করা।
- গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রতিফলন: ন্যায্য প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা 📊 বাংলাদেশে বর্তমান ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ (FPTP) পদ্ধতিতে প্রায়শই দেখা যায়, কম ভোট পেয়েও একটি দল সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এর ফলে অনেক ভোটারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না এবং সংসদ জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করে না। এই পদ্ধতি প্রায়শই “বিজয়ী সব পায়” নীতি অনুসরণ করে, যেখানে অল্প ভোটের ব্যবধানেও একজন প্রার্থী বা দল বিপুল সংখ্যক আসন লাভ করতে পারে, যা মোট ভোটের অনুপাতে ন্যায্য হয় না। পিআর পদ্ধতি চালু হলে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে তাদের সংসদীয় আসনের সংখ্যা আনুপাতিক হবে, যা গণতন্ত্রের একটি সত্যিকারের চিত্র তুলে ধরবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি দল জাতীয় পর্যায়ে ২৫% ভোট পায়, তাহলে তারা সংসদের প্রায় ২৫% আসন লাভ করবে। এর ফলে জনগণের ভোটের সঠিক মূল্য নিশ্চিত হবে এবং তাদের আস্থা বাড়বে, কারণ তারা দেখতে পাবে যে তাদের ভোট সরাসরি ফলাফলে প্রভাব ফেলছে। এটি সংসদের বৈধতা (legitimacy) বাড়ায় এবং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
- রাজনৈতিক বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংসদ: ক্ষুদ্র দলের উত্থান ✊ বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধানত কয়েকটি বৃহৎ দলের আধিপত্য বিদ্যমান, যেখানে ছোট বা নতুন দলগুলোর সংসদে প্রবেশ করা অত্যন্ত কঠিন। পিআর পদ্ধতি ছোট দল, আঞ্চলিক দল এবং নতুন গঠিত দলগুলোর জন্য সংসদে প্রবেশের পথ খুলে দেবে। এর মাধ্যমে জাতীয় সংসদে বিভিন্ন মতাদর্শ, জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি সংখ্যালঘু দল মোট ভোটের ৫% পায়, তারা সংসদে প্রায় ৫% আসন পাবে, যা বর্তমান FPTP ব্যবস্থায় প্রায় অসম্ভব। এটি রাজনৈতিক বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করবে এবং সমাজের সকল স্তরের কণ্ঠস্বর সংসদে পৌঁছে দেবে। এর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার ও দাবিগুলো সংসদে আলোচিত হতে পারবে, যা জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক সংহতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
- জবাবদিহিতা ও জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি: প্রতিটি ভোটের গুরুত্ব 📈 বর্তমান ব্যবস্থায় অনেক ভোটারের ভোট ‘নষ্ট’ হয়, বিশেষ করে যারা পরাজিত প্রার্থীকে ভোট দেন। এর ফলে অনেক ভোটার ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পিআর পদ্ধতিতে, যেহেতু প্রতিটি ভোটই দলের মোট ভোটের হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ, তাই প্রত্যেক ভোটারের ভোটই মূল্যবান এবং তারা মনে করবেন যে তাদের ভোট আসলেই প্রভাব ফেলছে। এটি ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে আরও বেশি উৎসাহিত করবে এবং তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা ও সম্পৃক্ততা বাড়াবে। যখন ভোটাররা জানেন যে তাদের ভোট ফলাফলে কার্যকর হবে, তখন তারা আরও দায়িত্বশীলতার সাথে ভোট দেবেন এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থাকবেন। এটি রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে।
- ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতি: জোট সরকারের সুফল 🤝 পিআর পদ্ধতির ফলে প্রায়শই কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না, যার ফলস্বরূপ জোট সরকার গঠন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা, সমঝোতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। এর ফলে এমন নীতি ও আইন প্রণীত হবে যা বৃহত্তর সংখ্যক মানুষের স্বার্থ পূরণ করে, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনকল্যাণমুখী শাসন নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। বর্তমানের ‘বিরোধী বনাম ক্ষমতাসীন’ মেরুকৃত রাজনীতি থেকে সরে এসে ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। এটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা কমাবে। জোট সরকার গঠনের প্রয়োজন হলে বিভিন্ন দল তাদের কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে পারবে।
- সংসদীয় বিতর্কের গুণগত মানোন্নয়ন: শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা 🗣️ বর্তমানে, বাংলাদেশের সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতি বা সীমিত উপস্থিতি প্রায়শই দেখা যায়, যা সংসদীয় বিতর্কের মানকে প্রভাবিত করে। পিআর পদ্ধতি কার্যকর হলে সংসদে বিরোধী দলের একটি শক্তিশালী এবং কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত হবে। এর ফলে গঠনমূলক বিতর্ক, সুচিন্তিত আলোচনা এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। সংসদীয় কার্যক্রমের গুণগত মান উন্নত হবে এবং আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া আরও কার্যকর ও অংশগ্রহণমূলক হবে। বিভিন্ন দলের উপস্থিতি সংসদের আলোচনাকে আরও প্রাণবন্ত করবে এবং সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে সাহায্য করবে, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং জনমুখী করবে।
- নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি: অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন 👩⚖️ অনেক পিআর পদ্ধতিতে, বিশেষ করে পার্টি-লিস্ট পিআর-এ, দলগুলো তাদের প্রার্থী তালিকায় নারী এবং বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিতে উৎসাহিত হয়। অনেক দেশে আইনগতভাবে এর জন্য কোটা পদ্ধতিও চালু আছে। বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালু হলে সংসদে নারী এবং অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে, যা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের দিকে নিয়ে যাবে। এটি শুধুমাত্র প্রতিনিধিত্ব বাড়াবে না, বরং তাদের বিশেষ চাহিদা ও সমস্যাগুলো আইন প্রণয়নের সময় গুরুত্ব পাবে, যা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য। এটি নারীর ক্ষমতায়ন এবং জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণে সহায়ক হবে।
- জাতীয় নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি: জনগণের আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ✅ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রায়শই বিতর্কের সৃষ্টি হয়, যা জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে। পিআর পদ্ধতি, বিশেষ করে যদি এটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে জনগণের আস্থা বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনবে। যখন জনগণ বিশ্বাস করে যে তাদের ভোট সঠিকভাবে গণনা হচ্ছে এবং ফলাফল ন্যায্যভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে, তখন তারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হয়। এটি রাজনৈতিক সহিংসতা কমাতে এবং নির্বাচনকালীন সংকটের সম্ভাবনা দূর করতে সহায়ক হতে পারে।
- নীতি প্রণয়নে ধারাবাহিকতা ও স্থায়িত্ব: দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা 🏗️ যদিও জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা থাকে, পিআর পদ্ধতি প্রায়শই এমন সরকার তৈরি করে যা একক দলের চেয়ে কম চরমপন্থী হয়। যেহেতু একাধিক দলের সমঝোতার মাধ্যমে নীতি নির্ধারিত হয়, তাই হঠাৎ করে বড় ধরনের নীতি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এটি নীতি প্রণয়নে ধারাবাহিকতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে, যা দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করে। পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে গঠিত সরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরও সক্ষম হতে পারে।
- মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বহুমাত্রিকতা: সমাজের প্রতিফলন 🗣️ পিআর পদ্ধতি সমাজের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও বৃহৎ মতাদর্শকে সংসদে উপস্থাপন করার সুযোগ দেয়। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যই নয়, বরং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা, ধর্ম এবং জাতিসত্তার মানুষের জন্য নিজেদের মত প্রকাশ এবং সংসদে তাদের দাবি তুলে ধরার সুযোগ সৃষ্টি করে। এর ফলে গণতন্ত্র আরও গতিশীল ও বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে এবং সমাজের বাস্তব চিত্র সংসদে প্রতিফলিত হয়। এটি জনগণের মধ্যে মালিকানা বোধ বাড়ায় এবং তাদেরকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনুভব করতে সাহায্য করে।
পিআর পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা: 🚧
যদিও পিআর পদ্ধতির অনেক সুবিধা রয়েছে, এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে যা সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে:
- জোট সরকারের সম্ভাব্য দুর্বলতা: পিআর পদ্ধতি প্রায়শই জোট সরকার গঠনের দিকে ধাবিত করে, যা কখনও কখনও অস্থির হতে পারে যদি জোটের শরিকদের মধ্যে মতবিরোধ তীব্র হয়। এর ফলে ঘন ঘন নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে এবং সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হতে পারে।
- জবাবদিহিতার চ্যালেঞ্জ: পার্টি-লিস্ট পিআর-এ ভোটাররা সরাসরি প্রার্থীর পরিবর্তে দলকে ভোট দেওয়ায় স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রতি ব্যক্তিগত জবাবদিহিতা কিছুটা কমতে পারে। একজন স্থানীয় ভোটার তার সংসদ সদস্যের কাছে সরাসরি অভিযোগ বা দাবি জানাতে কিছুটা সমস্যা বোধ করতে পারেন।
- সরকার গঠনে দীর্ঘসূত্রিতা: জোট সরকার গঠনে বিভিন্ন দলের মধ্যে সমঝোতার প্রয়োজন হওয়ায় এটি সময়সাপেক্ষ হতে পারে, যা শাসনকার্য শুরু করতে বিলম্ব ঘটাতে পারে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।
- চরমপন্থী দলগুলোর উত্থান: যেহেতু পিআর পদ্ধতি ক্ষুদ্র দলগুলোকেও সংসদে প্রবেশের সুযোগ দেয়, কিছু ক্ষেত্রে চরমপন্থী বা প্রান্তিক মতাদর্শের দলগুলোও সংসদে স্থান করে নিতে পারে, যা রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থির করতে পারে।
তবে, এই সীমাবদ্ধতাগুলো যথাযথ আইনি কাঠামো এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এর সুবিধার দিকগুলো বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যা গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
বিশ্বে পিআর পদ্ধতির প্রচলন 🌍
পিআর পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে অনেক দেশে জনপ্রিয়, বিশেষ করে ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে। এটি প্রমাণ করে যে, গণতন্ত্রকে আরও প্রতিনিধিত্বমূলক করতে পিআর পদ্ধতি একটি কার্যকর উপায়। কিছু উল্লেখযোগ্য দেশ যেখানে পিআর পদ্ধতি বা এর কোনো না কোনো রূপ চালু আছে:
- জার্মানি: জার্মানি মিক্সড মেম্বার প্রportional Representation (MMPR) পদ্ধতি ব্যবহার করে, যা FPTP এবং পার্টি-লিস্ট পিআর-এর সংমিশ্রণ। ভোটাররা দুটি ভোট দেন – একটি সরাসরি তাদের স্থানীয় প্রার্থীর জন্য এবং অন্যটি একটি রাজনৈতিক দলের জন্য। এটি স্থিতিশীলতা এবং প্রতিনিধিত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে।
- নিউজিল্যান্ড: নিউজিল্যান্ডও জার্মানির মতো MMPR পদ্ধতি অনুসরণ করে। ১৯৯৬ সালে তারা FPTP থেকে MMPR-এ স্থানান্তরিত হয় এবং এর ফলে সংসদে ক্ষুদ্র দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
- ইতালি: ইতালি ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ধরনের পিআর পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, বর্তমানে তারা একটি মিশ্র ব্যবস্থা ব্যবহার করে যেখানে আনুপাতিক এবং বহুত্ববাদী উভয় উপাদানই বিদ্যমান। ইতালির রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রায়শই জোট সরকারের ভাঙাগড়া দেখা গেছে।
- স্পেন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক: এই ইউরোপীয় দেশগুলো মূলত পার্টি-লিস্ট পিআর পদ্ধতি ব্যবহার করে। নেদারল্যান্ডস একটি উন্মুক্ত পার্টি-লিস্ট পিআর পদ্ধতি ব্যবহার করে যেখানে পুরো দেশ একটি একক নির্বাচনী এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা প্রতিটি ভোটকে সর্বোচ্চ মূল্য দেয়।
- ইসরায়েল: ইসরায়েল একটি অনন্য পদ্ধতি ব্যবহার করে যেখানে পুরো দেশ একটি একক নির্বাচনী এলাকা এবং ভোটাররা একটি দলকে ভোট দেন। এটি অত্যন্ত আনুপাতিক ফলাফল প্রদান করে।
- আয়ারল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া (কিছু ক্ষেত্রে): আয়ারল্যান্ড সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট (STV) পদ্ধতি ব্যবহার করে, যা ভোটারদের প্রার্থীর পছন্দের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নমনীয়তা প্রদান করে। অস্ট্রেলিয়া সিনেট নির্বাচনে STV ব্যবহার করে।
- দক্ষিণ আফ্রিকা: দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৪ সালে বর্ণবৈষম্যের অবসানের পর থেকে পার্টি-লিস্ট পিআর পদ্ধতি ব্যবহার করছে। এটি দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছে।
- ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা: এই ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো পার্টি-লিস্ট পিআর পদ্ধতি ব্যবহার করে। ব্রাজিলে একটি জটিল উন্মুক্ত পার্টি-লিস্ট পিআর পদ্ধতি প্রচলিত।
- কানাডা: যদিও কানাডায় প্রধানত FPTP পদ্ধতি প্রচলিত, তবে কিছু প্রদেশ এবং অঞ্চলে নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে এবং পিআর পদ্ধতির প্রচলনের পক্ষে অনেক সমর্থন রয়েছে।
- ভারত: ভারতের সংসদীয় নির্বাচনে FPTP পদ্ধতি প্রচলিত। তবে, ভারতের রাজ্যসভা (উচ্চ কক্ষ) এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট (STV) পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, যা পরোক্ষ নির্বাচন এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে।
- স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো (যেমন নরওয়ে): এই দেশগুলোও উন্নত পিআর পদ্ধতি ব্যবহার করে যা উচ্চ স্তরের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে।
এই দেশগুলোর অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে পিআর পদ্ধতি গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, প্রতিনিধিত্বমূলক এবং স্থিতিশীল করতে একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে, যদিও প্রতিটি দেশের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে উপযুক্ত পিআর পদ্ধতি নির্বাচন করা উচিত।
সোর্স:
International IDEA (International Institute for Democracy and Electoral Assistance):
লিঙ্ক: https://www.idea.int/
Britannica – Proportional Representation:
লিঙ্ক: https://www.britannica.com/topic/proportional-representation
কেন ব্যবহার করবেন: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা একটি সুপরিচিত এবং বিশ্বস্ত জ্ঞানের উৎস। পিআর পদ্ধতির একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্যবহুল ব্যাখ্যা এবং এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো এখানে পাবেন।
পিআর পদ্ধতির প্রয়োগ ও কেস স্টাডির জন্য:
- Electoral Reform Society (UK):
- Bundeswahlleiter (The Federal Returning Officer – Germany):
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এবং নির্বাচনী সংস্কার আলোচনার জন্য:
প্রথম আলো: https://www.prothomalo.com/
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন:
লিঙ্ক: https://www.ecs.gov.bd/
দ্য ডেইলি স্টার (The Daily Star) বা প্রথম আলো (Prothom Alo) এর আর্কাইভ:
দ্য ডেইলি স্টার: https://www.thedailystar.net/