সূরা আল-আসর এর দারস
বিষয়ঃ (ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায়)
🔹সূরা আল-আসর
وَالْعَصْرِ(১)
সময়ের কসম
إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ (২)
মানুষ আসলে খুবই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে।
إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (৩)
তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করতে থেকেছে এবং পরস্পরকে হক কথার ও সবর করার উপদেশ দিতে থেকেছে।
◼️ নামকরণঃ
প্রথম আয়াতের الْعَصْرِ“আল আছর” শব্দটিকে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
◼️ নাযিল হবার সময়কালঃ
মুজাহিদ, কাতাদাহ ও মুকাতিল একে মাদানী বলেছেন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক মুফাস্সির একে মাক্কী বলেছেন। এর বিষয়বস্তু থেকে বোঝা যায় মাক্কী যুগের প্রথম অংশে অবতীর্ণ। এর আকার মাক্কী সুরার বৈশিষ্ট্য বহন করে।
◼️ বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্যঃ
এর মধ্যে স্পষ্ট ভাষায়, মানুষের সাফল্য ও কল্যাণ এবং ধ্বংসের পথ বর্ণনা করা হয়েছে।
ইমাম শাফেয়ী বলেন- মানুষ যদি এই একটি সুরা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে তাহলে এটিই তাদের হেদায়েতের জন্য যথেষ্ট।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হিসন দারেমী আবু মাদীনা-
كَانَ الرَّجُلَانِ مِنْ أَصْحَابِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا الْتَقَيَا، لَمْ يَتَفَرَّقَا إِلَّا عَلى أَنْ يَقْرَأَ أَحَدُهُمَا عَلَى الْآخَرِ “سُوْرَةَ الْعَصْرِ” إِلى آخِرِهَا، ثُمَّ يُسَلِّمَ أَحَدُهُمَا عَلَى الْآخَرِ
রাসূলুল্লাহ (সা:) এর সাহাবীদের মধ্য থেকে যখন দুই ব্যক্তি মিলিত হতেন তখন তারা একজন অপরজনকে সুরা আছর না শোনানো পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হতেন না।’ (তাবারানী)
◼️ ব্যাখ্যাঃ
◽১ম বলা হয়েছে -
وَالْعَصْرِ " সময়ের কসম
সময় বলতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। এটি কোন দীর্ঘ সময় নয়। ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসা বর্তমান অতীতে নিপতিত হচ্ছে। আল্লাহ মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন আমি যে তোমাকে একটি হায়াত বা সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছি, তা থেকে প্রত্যেকটি মুহূর্ত, প্রত্যেকটি মিনিট, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর এভাবে তোমার সময় থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে তোমার জীবন। তুমি যে শৈশব কাল হারিয়েছো তার ফিরে পাবে না, তুমি যে বাল্যকাল হারিয়েছ তার ফিরে পাবে না, তুমি যে যৌবন কাল হারিয়েছো তা আর ফিরে পাবে না, সময় বা হায়াত এতই মূল্যবান একটি সম্পদ।
কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে আমরা আল্লাহর কসম করি , কিন্তু আল্লাহর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলে সে বিষয়ে আল্লাহ তা'আলা ওই বিষয়ের কসম করেন।
এবং সময়টাও খুবই মূল্যবান একটি সম্পদ, এজন্য আল্লাহ তায়ালা সময়ের কসম করেছেন।
এ ব্যাপারে সাঃ এর একটি হাদিস আছে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) এক ব্যক্তিকে নসিহত করতে গিয়ে বলেছেন, তুমি ৫টি সময়ের পূর্বে ৫টি বিষয়কে গুরুত্ব দাও।
১. বার্ধক্য আসার পূর্বেই যৌবনকে,
২. অসুস্থতা আসার পূর্বেই সুস্থতাকে,
৩. দারিদ্রতা আসার পূর্বেই স্বচ্ছলতাকে,
৪. ব্যস্ততা আসার পূর্বেই অবসরকে এবং
৫. মৃত্যু আসার পূবেই জীবনকে।
(বাইহাকী শুআবুল ঈমান)
এ প্রসঙ্গে ইমাম রাজি রঃ থেকে একটি উদ্ধৃতি বর্ণনা করেছেন যে, একবার দামেশক শহরে একজন বরফ বিক্রেতা চিৎকার দিয়ে বলছিল, “তোমরা এমন এক ব্যবসায়ীর প্রতি দয়া করা, যার পুঁজি অহরহ গলে যায়”। ইমাম রাজিরঃ বলেন এই বরফ বিক্রেতার কাছ থেকে আমি আসরের সূরা আসরের ব্যাখ্যা বুঝেছি । অর্থাৎ বরফ যেমন প্রতি মুহূর্তে গলে যায়, সময়ও তেমনি প্রতি মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যায়। তেমনি মানুষের হায়াতও ভবিষ্য বর্তমানে, বর্তমান অতীতে পরিণত হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। একজন ছাত্র যেমন পরীক্ষার হলে বসে অযথা সময় নষ্ট করে অবহেলা করে সময় শেষ করে ফেললে সে তার বিরাট ক্ষতি করে ফেলল, ঠিক তেমনি একজন মানুষ যদি তার হায়াতকে ভালো কাজে না লাগায়, তাহলে সেও মূলত বিরাট ক্ষতি করে ফেলল।
◽২য় বলা হয়েছে -
"মানুষ আসলে খুবই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে"
"তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করতে থেকেছে এবং পরস্পরকে হক কথার ও সবর করার উপদেশ দিতে থেকেছে"
অর্থাৎঃ চারটি গুন সম্পন্ন লোক ছাড়া বাকি সবাই ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে আছে -
🔹১) ঈমানঃ ঈমানের সমন্বয় হলো -
ক) মৌখিক স্বীকৃতি
খ) অন্তরে বিশ্বাস
গ) কাজে পরিণত করা।
কোরআনে ঈমানের ব্যাখ্যা-
“যারা বলেছে আল্লাহ আমাদের রব তারপর তার উপর অবিচল হয়ে গেছে।”(হা-মীম সিজদা-৩০)
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا
“আসলে তারাই মূমিন আল্লাহর কথা উচ্চারিত হলে যাদের দিল কেপে উঠে।”(আনফাল-২)
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ
“আসলে তারাই প্রকৃত মুমিন যারা আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে এরপর কোনরূপ সন্দেহে পতিত হয়নি।”(হুজুরাত,১৫)
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا
“যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ও অত্যন্ত মজবুতির সাথে ভালোবাসে।” (বাকারা-১৬৫)
وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّهِ
ঈমানের আসল লক্ষ্য হলো প্রকৃত ঈমান, কেবল মৌখিক স্বীকারোক্তি নয়। আল্লাহ বলেন -
হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনো।”(নিসা-১৩৬)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا آمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ
🔹২) সৎকাজঃ
দ্বিতীয় গুণটি হলো সৎকাজ। কুরআনের পরিভাষায় সালেহাত সমস্ত সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআনের দৃষ্টিতে, যে কাজের মূলে ঈমান আছে এবং যা আল্লাহ ও তার রাসূল (সা:) প্রদত্ত হেদায়াতের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছে তা, সৎকাজ। ঈমানের পর সৎকাজের বর্ণনার অর্থ হলো ঈমান বিহীন কোন সৎকাজের পুরস্কার দেয়ার …… নেই। সৎকাজ বিহীন ঈমান একটি দাবী ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈমান ও সৎকাজ বীজ আর বৃক্ষের মতো।
পরবর্তী দু’টি গুণ হলো – যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তারা পরস্পরকে হক কথা বলা হক কাজ করা এবং ধৈর্য্য ধারণের উপদেশ দিতে হবে। এর প্রাথমিক অর্থ হচ্ছে ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের পৃথক না থেকে সম্মিলিতভাবে একটি সৎ সমাজ দেহ গড়ে তুলতে হবে।
🔹৩) হকের উপদেশঃ
হক শব্দটি বাতিলের বিপরীত দু’টি অর্থ- বহন করে, -
ক) সঠিক, নির্ভুল, সত্য অনুসারী এবং আকিদা ও ঈমান এর পথে চলার উপদেশ।
খ) বান্দার বা হক
(১) বাতিল মাথা উঁচু করে দাড়ালে হক পন্থীরা নিরব দর্শক নয়, বরং বাতিল এর বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে থাকে।
(২) সমাজে প্রানশক্তি বজায় থাকে।
(৩) হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে হক পন্থীরা অন্যদেরকেও হকের উপদেশ দেয়।
সুরা মায়েদার (৭৮-৭৯) তে বলা হয়েছে-
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ (78) كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ
‘হযরত দাউদ ও হযরত ঈসা (আ:) এর মুখ দিয়ে বনী ইসরাঈল জাতির উপর লা’নত করা হয়েছে কারণ তাদের সমাজে গোনাহ ও জুলুম ব্যাপক বেড়ে গিয়েছিল এবং লোকেরা পরস্পরকে খারাপ কাজে বাধা দিত না।’
🔹৪) সবরের উপদেশঃ
হকের নসিহত করতে গিয়ে বা হকের সমর্থন করতে গিয়ে যে সব সমস্যা ও বাধার মুখে নিপতিত হতে হয় তার মোকাবেলায় তারা পরস্পরকে অবিচল ও দৃঢ় থাকার উপদেশ দিতে থাকবে। বাতিল শক্তি যতই অত্যাচার, নির্যাতন, জুলুম করুক না কেন তারা ধৈর্য ধারণ করে হকের উপরেই অবিচল থাকে, আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা মনে করে,
যার ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলা সুরা বাকারায় বলেন-
❝অবশই তোমাদের পরিক্ষা করা হবে, ভয় দেখিয়ে, ক্ষুদা, জান ও মালের ক্ষতির মাধ্যমে, ব্যাবসামের মন্দা, ফল-ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে, এ অবস্থায় যারা সবব করে তাদের জন্য সুসংবাদ। বাকারা-১৫৫ নং আয়াত
আর যখনই কোন ধরনের বিপদ আসে তারা বলে- আমরা আল্লাহর জন্য আর আমাদেরকে তারই দিশে ফিরে যেতে হবে, হে নবী এমস্ত লোকদের সুখবর দাও।
বাকারা-১৫৬ নং আয়াত
তোমরা কি মনে করেছো, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে? অথচ তোমাদের আগে যারা ঈমান এনেছিল তাদের ওপর যা কিছু নেমে এসেছিল এখনও তোমাদের ওপর সেসব নেমে আসেনি। দারিদ্রতা ও বিপদ-মুসিবত, তাদেরকে প্রকম্পিত করেছিল। এমনকি সমকালীন রসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চীৎকার করে বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? তখন তাদেরকে এই বলে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছিল, অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।
বাকারা- ২১৪ আয়াত
◼️ শিক্ষাঃ
(১) দুনিয়া ও আখেরাতের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রকৃত ঈমানদার হতে হবে। এবং সময়ের যথাযথ মূল্য দিতে হবে।
(২) প্রকৃত ঈমানদারকে অবশ্যই সৎকাজ করতে হবে এবং পরস্পরকে হকের উপদেশ দিতে হবে।
(৩) ঈমানদারকে অবশ্যই বাতিলের বিরুদ্ধে লড়তে হবে এবং বাতিলকে মাথা উচু করে দাড়াতে দেবেনা।
(৪) হক পথে চলার সময় সমস্ত বাধা বিপত্তি অবশ্যই ধৈর্য্য ধরে সামনে অগ্রসর হতে হবে।
কোরানেরআলো jamaate islami islami chatro shibir jamat shibir jamaat shibir jamaat shibir online Bangladesh jamaat e islami জামাত শিবির জামায়াতে ইসলামী ইসলামী ছাত্র শিবির দারসুল কোরআন দারসুল কোরান
No comments:
Post a Comment