গুইসাপ খাওয়া হারাম এবং সান্ডা হালাল – ইসলামি দৃষ্টিকোণ, হাদীস ও ওলামায়ে কেরামের ব্যাখ্যা
✍️ ভূমিকা
গ্রামবাংলায় আমরা প্রায়ই এমন দুটি প্রাণীর নাম শুনে থাকি—সান্ডা ও গুইসাপ। দেখতে প্রায় একই রকম হওয়ায় অনেকেই এদের এক মনে করলেও, বাস্তবতা ভিন্ন। ইসলামি শরিয়তের আলোকে এদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মতভেদ। এই লেখায় আমরা হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের আমল, চার মাজহাবের ইমামগণের মতামত এবং বর্তমান যুগের বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করব, ইনশাআল্লাহ।
🦎 সান্ডা কী?
সান্ডা (Uromastyx spp.) মরুভূমিতে বসবাসকারী এক প্রকার নিরীহ টিকটিকি জাতীয় প্রাণী। এটি তৃণভোজী, বিষমুক্ত এবং নিরীহ প্রকৃতির। মূলত আরব দেশগুলোতে সান্ডার প্রচুর বিস্তার দেখা যায়। এর লেজ মোটা ও খাঁজযুক্ত, যা আত্মরক্ষায় ব্যবহৃত হয়।
🐊 গুইসাপ কী?
গুইসাপ (Water Monitor – Varanus salvator) হলো একটি বড় মাপের, উভচর এবং মাংসাশী প্রাণী। এটি সাধারণত নদী, বিল বা জলাশয়ের আশেপাশে দেখা যায়। মৃত প্রাণী পর্যন্ত খেয়ে থাকে। তার আচরণ অনেকটা কুমিরের মতোই ভয়ংকর ও আক্রমণাত্মক। এদের লালায় ব্যাকটেরিয়া ও ক্ষতিকর উপাদান থাকে বলেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হিসেবে বিবেচিত।
📖 হাদীসে সান্ডা খাওয়া প্রসঙ্গে
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
“আমি ও খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সঙ্গে ছিলাম। তখন আমাদের সামনে সান্ডা আনা হলো। রাসূল (ﷺ) তা খেতে অস্বীকার করলেন। খালিদ বললেন, আপনি কি এটা হারাম করেছেন?
রাসূল (ﷺ) বললেন, ‘না, তবে এটা আমার জাতির মধ্যে ছিল না, তাই আমি এটি অপছন্দ করি।’”
— আল হাদীস
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়:
- সান্ডা হারাম নয়
- রাসূল (সা.) নিজে না খেলেও অন্যকে খেতে নিষেধ করেননি
- সাহাবাগণ তা খেয়েছেন
📖 গুইসাপ খাওয়া প্রসঙ্গে
গুইসাপ সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে হাদীস পাওয়া না গেলেও, রাসূলুল্লাহ ﷺ সাপ, শিয়াল, চিতা, হায়েনা, দাঁড়কাক ইত্যাদি খাওয়া নিষেধ করেছেন। গুইসাপ এদের মতোই মাংসাশী, আক্রমণাত্মক, এবং মৃতজীবী প্রাণী।
অনেক ফিকহবিদ এই জাতীয় প্রাণীকে "সবাআ (السباع)" বা "হিংস্র শিকারি প্রাণী" এর কাতারে ফেলেছেন, যা খাওয়া হারাম।
🕌 ইমামদের মতামত
- হানাফি মাজহাব: সান্ডা খাওয়া মাকরূহ (অপছন্দনীয়), হারাম নয়। গুইসাপ খাওয়া হারাম, কারণ এটি মাংসাশী এবং মৃতজীবী।
- মালিকি মাজহাব: সান্ডা হালাল, স্পষ্ট কোনো নিষেধ নেই। গুইসাপ হারাম, সব হিংস্র প্রাণী নিষিদ্ধ।
- শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাব: সান্ডা হালাল, হাদীসে নিষেধ নেই। গুইসাপ খাওয়া মাকরূহ অথবা হারাম, একাধিক ওলামার মতানুযায়ী।
🧠 ওলামায়ে কেরামদের মতামত
- শায়খ ইবনে বায (রহ.): “সান্ডা হালাল; রাসূল (সা.) নিজে না খেলেও সাহাবারা খেয়েছেন। কিন্তু গুইসাপ হলো মৃতজীবী প্রাণী; এগুলো হারাম।”
- মুফতি তকি উসমানি (হাফি.): “গুইসাপ শিকারি প্রাণী এবং ইসলাম এ ধরনের প্রাণী খাওয়া নিষিদ্ধ করেছে। সান্ডা ভিন্ন জাতি এবং তার শরিয়তসম্মত ভিত্তি রয়েছে।”
🧪 বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিবেচনায়
দিক | সান্ডা | গুইসাপ |
---|---|---|
খাদ্যাভ্যাস | গাছপালা, পোকা | মৃতজীবী, কাঁকড়া, ব্যাঙ |
বিষাক্ততা | নেই | বিষ বা ব্যাকটেরিয়া রয়েছে |
ধর্মীয় বিধান | হালাল বা মাকরূহ | হারাম |
আচরণ | শান্ত | হিংস্র |
📌 উপসংহার
ইসলাম মানুষের জন্য যা নিরাপদ, তা-ই হালাল করেছেন; আর যা ক্ষতিকর, তা হারাম। সান্ডা একটি নিরীহ প্রাণী, যা হালাল বা সর্বোচ্চ মাকরূহ। কিন্তু গুইসাপ একটি হিংস্র, মৃতভোজী প্রাণী, যা ইসলামি শরিয়তের আলোকে হারাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস, সাহাবাদের আমল, ইমামদের মতামত এবং আধুনিক ওলামায়ে কেরামের ব্যাখ্যা—সবকিছুই এ সত্য প্রমাণ করে।
📣 আপনার কী মতামত?
আপনি কি কখনো এদের কাউকে খেয়েছেন? আপনার গ্রামে কি এ নিয়ে বিভ্রান্তি আছে? নিচে কমেন্ট করে জানিয়ে দিন!
No comments:
Post a Comment